বিলুপ্তির পথে বাংলার শকুন
৫ সেপ্টেম্বর ছিল 'আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস'। এবারই প্রথম এ দেশে দিবসটি পালন করেছে বাংলাদেশ শকুন গবেষণা ও সংরক্ষণ প্রোগ্রাম, ওরিয়েন্টাল বার্ড ক্লাব, বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব এবং ডবিল্গউআরসিসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন। সম্প্রতি এ দেশে শকুনের কী অবস্থা, তার একটি জরিপ পরিচালনা করে বাংলাদেশ শকুন গবেষণা ও সংরক্ষণ প্রোগ্রাম। তাদের গবেষণায় শকুন হারিয়ে যাওয়ার ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব ও বাংলাদেশ নেচার স্ট্যাডি অ্যান্ড কনজারভেশন ইউনিয়নও দীর্ঘদিন ধরে শকুনের ওপর জরিপ করে আসছে।
লিখেছেন সীমান্ত দীপু
এ দেশে শকুনের যে ক'টি প্রজাতি আছে, তার মধ্যে বাংলা শকুন ছাড়া প্রায় সব ক'টি জাতই হারিয়ে গেছে। বাংলা শকুনও বিলুপ্তির পথে। এদের টিকে থাকার জন্য খাবার আর আবাসস্থল নেই বললেই চলে। সিলেটের গভীর বন আর সুন্দরবনে কালেভদ্রে শকুনের দেখা মেলে।
আসলে শকুনকে ছোট-বড় প্রায় সবাই নামে চেনেন। সত্তরের দশক পর্যন্ত এ দেশে শকুনের দল সহজেই চোখে পড়ত। নব্বইয়ের গোড়ায় দেখেছি, মরা গরু খেতে শকুনের দল কোথা থেকে যেন হঠাৎ হাজির হতো। ভাগাড়ে শকুন আর কাকের চেঁচামেচিতে গ্রামের লোকজন জমে যেত। লোকশ্রুতি এমন যে, গরু মারা গেলে কাক শকুনকে দূরদেশে খবর দিতে যেত। আর ফেরার পথে ছোট্ট কাক দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে না পেরে শকুনের পিঠে চড়ে বসত। এর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। আসলে শকুন আকাশের অনেক উঁচুতে উঠে ডানা মেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা উড়তে থাকে। এদের দৃষ্টিশক্তি এতই প্রখর যে, মাটিতে অথবা পানিতে ভেসে থাকা যে কোনো মরা বস্তু সহজেই দেখতে পায়। তবে শকুনের ঘ্রাণশক্তি নেই। মাত্র এক প্রজন্মের মধ্যে শকুন হারিয়ে গেলেও এ নিয়ে এ দেশে এতদিন পর্যন্ত কোনো আলোচনা হয়নি। অথচ শকুন মানুষের শত্রু নয়, বরং বন্ধুই।
জরিপে গত বছর হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে বাংলা শকুনের একটি বড় দল দেখা গিয়েছিল। পুরনো দুটি আমগাছে বাসাও বেঁধেছিল তিন জোড়া শকুন। মাত্র এক মাসের মাথায় আমগাছগুলো কেটে ফেলা হয়। ফলে বহুদিন পর বাংলাদেশে দেখা শকুন ডিম পাড়লেও বাচ্চা ফুটাতে পারেনি। পাখি বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আর হয়তো শকুন এদেশে বাসা করার আস্তানা পাবে না। কিন্তু এই দুঃসংবাদ সংবাদ সত্ত্বেও কিছুটা আশাসঞ্চার হল সম্প্রতি। জুলাই-২০০৯-এ শ্রীমঙ্গলের গভীর বনে দেখা মিলল প্রায় ১৬টি শকুনের বড় একটি দলের। ধারণা করা হচ্ছে, এ দেশে এর চেয়ে বড় শকুনের দল আর নেই। শকুনের বাসা পাওয়া না গেলেও ওই এলাকায় শকুনের বাসা আছে বলে পাখি পর্যবেক্ষকরা বলছেন।
বাংলাদেশে ৫ প্রজাতির শকুনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বাংলা শকুন। এর বৈজ্ঞানিক নাম জেপস বেঙ্গালেনসিস। এজন্য বাংলা শব্দটি চলে এসেছে। এখন গোটা পৃথিবীতেই শকুনের অবস্থা খুবই ভয়াবহ। সংখ্যায় ১০ হাজারের বেশি হবে না। বাংলাদেশে বাংলা শকুন এখন বিরল প্রজাতি। সব মিলিয়ে এ দেশেও এদের সংখ্যা ২০০-এর বেশি হবে না। তাও আবার বেশিরভাগই দেখা যায় সুন্দরবন এলাকায়। আগামী ৫ বছরের মধ্যে এ দেশও শকুনশূন্য হয়ে পড়বে। ঢাকার টঙ্গী এলাকায় একসময় শকুন দেখা যেত। এখনও দু'একটির দেখা মেলে চিড়িয়াখানার আশপাশে। এ দেশ থেকে শকুন হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো প্রজননের জন্য আবাসস্থলের অভাব। এরা সাধারণত বট, শিমুল, দেবদারু ও তালসহ বড় বড় দেশি গাছে বাসা বাঁধে। কিন্তু এসব দেশি গাছের আজ বড়ই অভাব। একজোড়া স্ত্রী-পুরুষ বছরে মাত্র একবার একটিমাত্র ডিম পেড়ে বাচ্চা ফুটায়। কোনো কোনো সময় দুটি ডিমও দিতে পারে। ফলে এদের সংখ্যা বৃদ্ধির হারও খুবই কম। এছাড়া বাংলাদেশসহ পুরো এশিয়ার গবাদিপশুকে ডাইক্লোফেনাক নামক ওষুধ সেবন করানো হয়। ফলে গরু মারা যাওয়ার পরও ঐ ঔষধের কিছু কার্যক্ষমতা বজায় থাকে। শকুন মরা গরু খেলে তার শরীরে ওই ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় শকুনের মৃত্যু হয়। এছাড়া বর্তমানে গরু কম মারা যায় কিংবা গেলেও পুঁতে ফেলা হয়। এতে দিন দিন তাদের খাবারও একেবারেই কমে এসেছে। ফলে হারিয়ে গেছে প্রায় ৯৯.৫ শতাংশ বাংলা শকুন।
ভারত সরকার ক্লোফেনাক জাতীয় ওষুধ নিষিদ্ধ করেছে। ভারতে এক গবেষণায় দেখা গেছে, একটি ক্লোফেনাক ট্যাবলেট একটি শকুনকে খাওয়ানোর কিছুক্ষণ পরই মারা যায়। এই ওষুধের বিষক্রিয়ায় এদের কিডনিতে পানি জমে যায়। ভারত সরকার ওষুধটি নিষিদ্ধ করলেও বাংলাদেশ সরকার কিন্তু নিষিদ্ধ করেনি। বরং এ দেশ থেকেই ভারতে পাচার হচ্ছে ওষুধটি।
পরিবেশের জন্য শকুন খুবই মূল্যবান একটি পাখি। হবিগঞ্জে এদের বাসা পাওয়াটা খুবই আশার কথা। ভারতে শকুনের ক্যাপটিভ ব্রিডিং শুরু হয়ে গেছে। কাজেই শকুনকে হারিয়ে ফেলার আগেই আমাদের সচেতন হতে হবে। বাড়াতে হবে এদের প্রজনন ক্ষেত্র। অথবা ক্যাপটিভ ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে এদের সংখ্যা বাড়িয়ে ছেড়ে দিতে হবে পরিবেশে।