বিলুপ্তির আশঙ্কায় পানিকাটা পাখি
প্রণব বল, চর বাহাউদ্দিন থেকে ফিরে
বিচরণভুমি ক্রমাগত কমে যাওয়ায় বিরল প্রজাতির পাখি পানিকাটা বা গাঙচষা দেশ থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এ দেশে এদের মূল আবাসস্থল একসময়কার হাতিয়ার জনমানবহীন চর বাহাউদ্দিন (দমারচর)। কিন্তু সেখানে আগের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা যায় না এদের। কুয়ালালামপুরভিত্তিক এশীয় জলচর পাখি শুমারি সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে এ চরে দুই থেকে আড়াই হাজার পানিকাটা আছে। অথচ তিন-চার বছর আগে এ সংখ্যা ছিল সাত হাজারের মতো।
কমলা ও হলুদ রঙের লম্বা আকর্ষণীয় ঠোঁটের পানিকাটা পাখির প্রজননভুমি বালুচর। বালিতে ডিম পাড়ে তারা। এ স্বভাবই তাদের বংশবিস্তারের জন্য কাল হয়েছে। বছরখানেক ধরে চর বাহাউদ্দিনে মানুষের বসতি স্থাপন শুরু করেছে। সঙ্গে গরু-মহিষ। এদের উৎপাতে পানিকাটার ডিম ও বাচ্চা ব্যাপক হারে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে তাদের বিলুপ্তির আশঙ্কা।
আবুধাবি চিড়িয়াখানার প্রধান এবং বিশিষ্ট প্রাণী ও পাখি-বিশেষজ্ঞ ড. রেজা খান এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, চরে বসতি গড়ে উঠলে সেটা পানিকাটার জন্য বিপজ্জনক হবে। কারণ, এরা বালুচরেই ডিম পাড়ে। নির্জন ওই অঞ্চলে গরু-মহিষ বা মানুষ বিচরণ শুরু করলে বংশবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়ে পাখির এ প্রজাতিটি আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। চর বাহাউদ্দিন ছাড়া দেশের আর কোথাও এখন পর্যন্ত ইন্ডিয়ান স্কিমার বা পানিকাটা তেমনভাবে দেখা যায় না বলে তিনি জানান।
অনন্য পানিকাটা: লম্বায় ৪০ থেকে ৪৩ সেন্টিমিটার। ডানা দীর্ঘাকৃতির। ওপরের অংশ কালো, প্রান্ত সাদাটে। কপালসহ নিচের অংশ সাদা। ঝুঁটির ওপর কালো বড় টিপ। লম্বা দুই পা লাল রঙের। ডানার গঠন অনেকটা অ্যালব্যাট্রসের মতো। বড় ডানায় ভর করে পানি ও বালুময় বিচরণক্ষেত্রে প্রায় সারা দিন উড়ে বেড়ায়। ডানার তুলনায় শরীর ছোট। ঠোঁটটি চিকন লম্বাটে, উজ্জ্বল কমলা রঙের। ঠোঁটের ডগা হলুদ। লাঙলের ফলার মতো ওপরের চেয়ে নিচের ঠোঁট লম্বা। উড়ন্ত অবস্থায় নিচের চোয়াল পানিতে ডুবিয়ে মাছ শিকারে তারা পারঙ্গম। একটি বিশেষ ধরনের পাতলা মাছ পানিকাটার খাদ্য। শুধু দিনে নয়, চাঁদের আলোয়ও পাখিটি মাছ শিকার করে। কখনো উড়ন্ত অবস্থায়, কখনোবা বালুচরে নেমে তা গিলে ফেলে। চরে বসে ডিমে তা দেয় পানিকাটা। তিন সপ্তাহের মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। তিন-চারটি ডিম থেকে বড়জোর একটি বাচ্চা বাঁচে।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন), বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত রেড ডেটা বুক-এর তথ্যানুযায়ী, পানিকাটা বিশ্বব্যাপী একটি বিপন্ন পাখি। এশীয় জলচর পাখি শুমারি সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশেই বর্তমানে এ পাখির সংখ্যা সর্বোচ্চ। এ ছাড়া ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের নির্দিষ্ট কিছু স্থানে এ পাখিটি দেখা যায়।
১১ মে সরেজমিনে দেখা যায়, চর বাহাউদ্দিনের একপাশে ঘন কেওড়াগাছের সারি। অন্যদিকে বালু ও কাদাময় চরে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির ভিড়ে কিছু কালো-সাদা রঙের পানিকাটা মাছ শিকার করছে, চরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু চার-পাঁচ মাস ধরে এ চরে প্রায় ৭০০ পরিবার বসবাস শুরু করছে। অবাধে চরছে গরু-মহিষ। দিন দিন বাড়ছে চর দখল।
চার মাস আগে চরে এসে বসতি গড়া মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, ‘আমরা মালেক নেতার (আবদুল মালেক) কাছ থেকে তিন হাজার টাকায় এক একরের এ দখল কিনেছি। এখন শুধু বেড়ার ঘরটি করে দেওয়া হয়েছে। পরে জমি মেপে দেওয়া হবে।’ চর দখল নিয়ে বন বিভাগের সঙ্গে মামলার কারণে মালেক বর্তমানে কারাগারে। কিন্তু মালেক না থাকলেও চর বাহাউদ্দিনের দখল থেমে নেই। মালেকের প্রতিদ্বন্দ্বী মোহাম্মদ শাহেদ মূল হাতিয়া থেকে লোকজন নিয়ে এসে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে এ চরে আশ্রয় দিচ্ছেন।
অসংরক্ষিত চর: এ প্রতিবেদক চরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর সেখানে একটি ইঞ্জিন নৌকায় সাতজনের দল নিয়ে হাজির হন মোহাম্মদ শাহেদ। দখল সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আবদুল মালেকই চর দখল করে অনেক লোক এখানে এনে বসিয়েছেন। তাঁরা নিজেরা বেশি লোক বসাননি। এ কথা বলার পাশাপাশি শাহেদ বলেন, আমরা তো সংরক্ষিত বনের কোনো ক্ষতি করছি না।
প্রসঙ্গত, বন বিভাগ থেকে প্রায় আড়াই হাজার একরের চর বাহাউদ্দিনকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব করা হয়েছে। বন বিভাগ সুত্রে জানা গেছে, বিষয়টি এখনো প্রস্তাব পর্যায়ে রয়ে গেছে। প্রস্তাবটি বাস্তবায়নে জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এ কারণে নিচের সারির স্থানীয় বন কর্মকর্তারা দখলদারদের কাছে অনেকটা অসহায় হয়ে আছেন।
চর রৌশন বিটের বিট কর্মকর্তা রবীন্দ্র কুমার সিংহ জানালেন, মাস তিনেক আগে চর দখলে বাধা দিতে গেলে দখলদার মালেক নেতার সঙ্গে বন বিভাগের নিরাপত্তা প্রহরীদের মারামারি লেগে যায়।
এ প্রসঙ্গে নোয়াখালী উপকুলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন সংরক্ষক (ডিএফও) মো. শফিউল আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মালেক নেতার বিরুদ্ধে আমরা মামলা করেছি। বর্তমানে তিনি কারাগারে। আমাদের লোকজন অনেক সময় তাদের সঙ্গে পেরে ওঠে না। বনাঞ্চলের দিকে এলে আমরা বাধা দিই।’ চরে বসতির কারণে তিনিও বিরল প্রজাতির সুন্দর পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন।
প্রকৃতিবিদ রোনাল্ড হালদার বলেন, ফেব্রুয়ারি থেকে মে-জুন পর্যন্ত পানিকাটার ডিম পাড়ার সময়। এদের জন্য তাদের দরকার উৎপাতহীন পরিবেশ। এভাবে চর দখল চললে পানিকাটা হারিয়ে যেতে বেশি সময় লাগবে না। তিনি আরও বলেন, ‘গত ডিসেম্বরেও আমি চর বাহাউদ্দিনে গিয়ে সেখানে কোনো বসতি দেখিনি। কিন্তু এ বছরের এপ্রিলের শেষ দিকে পাখি-পর্যবেক্ষক ইনাম আল হক ও আমি চরে গিয়ে দেখেছি বসতি শুরু হয়েছে। আগের চেয়ে পাখির সংখ্যাও কমেছে।’
চর বাহাউদ্দিন দখল হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবুল হাশেমও। তিনি বলেন, ভুমিহীন কিছু লোক ওখানে বসতি শুরু করেছে। অনেকে এদের নিয়ে ব্যবসাও করছে। পুলিশ ও প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. গাজী সৈয়দ মোহাম্মদ আসমত বলেন, প্রজননকালে বালুচরে উৎপাত থাকলে পাখিটি আস্তে আস্তে বিরল হয়ে যেতে পারে।
ড. রেজা খান বলেন, শুধু বন বিভাগকে দিয়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করেই এ ধরনের বন্য পশুপাখি রক্ষা করা সম্ভব নয়। এ জন্য স্বতন্ত্র বন্যপ্রাণী বিভাগ দরকার, যাদের কর্তব্য হবে শুধু পশুপাখি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা।
-------
প্রথম আলো।
0 comments:
Post a Comment