Sunday, June 1, 2008

পাখির জন্য শোকগাথা

শরীফ খান

বাগেরহাট জেলার ফকিরহাটের কোমরপুরের বিল। ওই বিলের এক প্রান্তে মাঝারি মাপের একটি চিংড়িঘের। ঘেরের মালিক তরুণ আব্দুল কুদ্দুস ঘেরের চিংড়িগুলোকে খাবার দিচ্ছেন। রোজই দেন এবং রোজই এক জোড়া সরালি হাঁসকে (Lesser whistling duck) ঘেরের জলে চরতে দেখেন। নিরীহ পাখি। মাছের ক্ষতি করেই না বলতে গেলে। কুদ্দুস ওদের তাই বলেন না কিছু।
২০০০ সালের জুন মাস। তারিখটি মনে নেই কুদ্দুসের, তবে আষাঢ়ের সেদিন ছিল ২ তারিখ। ঘেরে কাজ করার সময় কুদ্দুস একটি পাখি দেখেন। অন্যটি! যা ভেবেছিলেন তা-ই, একটু খুঁজতেই তিনি চওড়া উলুঘাসের আইলের ভেতর পেয়ে যান ডিম বুকে বসা মা-পাখিটাকে। কাছে গেলে উড়ে যায়। কুদ্দুস পেয়ে যান ১১টি ডিম। দেখতে দেশি মুরগির ডিমের মতো।
ডিমগুলো নিয়ে বাড়ি ফিরলেন কুদ্দুস। ডিমে তা দেওয়া মুরগি (ফকিরহাটে বলে ‘উমনে মুরগি’) ছিল বাড়িতে। ১১টি ডিমে বসিয়ে দেওয়া হলো মুরগিটি। ২৮ দিন পর ছানা ফুটল। মুরগিমাতার খুশি তখন দেখে কে! ‘কুটকুট’ করে কত কথা যে সে বলে চলল তুলতুলে ছানাদের সঙ্গে! কুদ্দুসও মহা খুশি। খুশি তাঁর পুরো পরিবার। পাইকপাড়া গ্রামবাসীও খুশি। কিন্তু বেশি খুশিতে গদগদ মুরগিমাতা নিজেই গায়ের চাপে মেরে ফেলল দুটি ছানা। নয়টি টিকে রইল।
মুরগিমাতা তো এই ছানাদের খাবার তালিকা জানে না। আবার ছানারা নামে জলে, মা তো থাকে ডাঙায়। এ রকম কৌতুককর দৃশ্য ফকিরহাট অঞ্চলে আজও হরহামেশা দেখা যায়। পোষা পাতিহাঁসের ছানা চরছে জলে আর ওদের ‘তা-মা’ ডাঙায় থেকে ছানাদের পাহারা দিচ্ছে।
চিল-বাজ দেখলেই ছানাদের রক্ষার জন্য জলে গিয়ে পড়ছে উড়ে। ফকিরহাটের মানুষ সরালি হাঁস, বালি হাঁস (Cotton pygmy goose), ডাহুক, কোড়া, কালিম, মেটে হাঁস (Spot-billed duck), বুনো কোয়েল (Barred Button Quail) প্রভৃতি পাখির ডিম মুরগির তায়ে ফোটাতে অভ্যস্ত; জানে ছোট ছানাদের খাবারের তালিকাও। অতএব প্রথম চার-পাঁচ দিন কুদ্দুস মাটির চাড়ি ও অ্যালুমিনিয়ামের গামলার জলে ভাসিয়ে দিলেন ছোট ছোট খুদিপানা বা খুদিশ্যাওলা। মুরগিমাতা রাগে ডাকে আর চাড়ি-গামলার পাশে ঘোরে; কানায় উঠে ছানারা কেমন আছে, তা লক্ষ করে। সাত-আট দিন বয়সে কুদ্দুস চিংড়ির খাবার আপেল, শামুক ভেঙে ভেতরের মাংস ব্লেড দিয়ে কুচি কুচি করে কেটে গামলা-চাড়ির জলে ফেলে দেওয়া শুরু করেন। ছানারা খায় হুড়োহুড়ি-ডুবোডুবি করে। মায়ের পেছনে পেছনে হাঁটে। মায়ের পিঠে ও পক্ষপুটে ঢুকে বিশ্রাম নেয়।
শামুকের মাংস খেয়ে ছানারা বাড়তে থাকে দ্রুত। এ সময় কুদ্দুস বাড়ির সামনে দিয়ে প্রবাহিত জোয়ার-ভাটা খেলা একটি খালের কালভার্টের পাশে বেড়া ও নেট দিয়ে তৈরি করেন বড়সড় একটি খাঁচা বা ঘর। ঘরের ভেতরে মাচান করে মাচানের ওপর বসিয়ে দেন কাঠের কয়েকটি বাক্স।
১৫ দিন বয়স থেকে ছানাগুলোর খাওয়ার মাত্রা বেড়ে যায়। খাঁচার ভেতরের জলেই ফেলা হয় শামুকের মাংস ও ধান। প্রতিদিন মাংসই লাগে ওদের দেড়-দুই কেজি।
উড়তে শেখার পর খাঁচাবন্দী হয়ে পড়ল ওরা। ২০০১ সালের ওই আষাঢ় মাসেই কাঠের বাক্সে ডিম দিল একটি হাঁস। সাতটি ডিম। পাঁচটি ছানা ফোটে। নষ্ট হয় দুটি। ছানারা বাক্স থেকে লাফিয়ে নামে জলে। কয়েক ঘণ্টার ভেতর পুরুষ হাঁসগুলো ছানাগুলোকে ঠুকরে-আছড়ে মেরে ফেলে। কুদ্দুস মর্মাহত হন ভীষণভাবে। এরই মধ্যে তিনি পুরুষ ও মেয়ে হাঁস শনাক্ত করতে শিখে গেছেন ভালোভাবে।
২০০২ সালের আষাঢ়ে একই বাক্সে ডিম দেয় দুটি মাদি হাঁস। বাক্স আরও ছিল। দুই বাক্সে ডিম দিলে ঝামেলা ছিল না কিছু। দুটিতে ডিম দেয় ১১টি। তা দেওয়ার সময় ঠেলাঠেলি-গুঁতোগুঁতি, মারামারি। অতএব ১০টি ডিমই নষ্ট হয়। একটি ছানা ফোটে।
২০০৩ সালের ডিমগুলো থেকে একটি ছানাও ফোটেনি।
২০০৪ সালের দিকে কুদ্দুসের বিশ্বাস জন্নায়, খাঁচার দরজা খুলে দিলেও পাখিগুলো পালাবে না। প্রভুকে চিনেছে ভালোভাবে। দেখলেই আনন্দধ্বনি দেয়। হাত থেকে খাবার খায়; এমনকি বহু রাতে দুর থেকেও প্রভুর কন্ঠস্বর শুনলে ডাকাডাকি করে যেন প্রশ্ন করে: কেমন আছ, প্রভু? শুভ রাত্রি। কুদ্দুসও বুঝতে পারতেন ওদের ভাষা।
হ্যাঁ, প্রভুর বিশ্বাস ভঙ্গ করেনি ওরা। সকালে খাঁচা থেকে বেরিয়ে উড়ে যেত দুরে−কাছের বিল ও চিংড়ির খামারগুলোতে। দুপুরে ফিরত। আবার বেরোত বিকেলে। ফিরত সন্ধ্যায়। বাক্সের ওপরে কাটাত রাত। রাতেও চরত খাঁচার ভেতরের জলে।
দিনে দিনে বাড়ল সাহস। ফকিরহাটের বিখ্যাত উত্তরের হাওর ও বাংলাদেশের কুয়েতখ্যাত ফলতিতা পাইকপাড়া। পাখিগুলো যেতে শুরু করল ওদিকেও।
শীতে উত্তরের হাওর তো বটেই, বাগেরহাট জেলার নির্দিষ্ট কয়েকটি স্পটে আজও আসে সাত-আট প্রজাতির দেশি-বিদেশি বুনো হাঁস। স্বজাতিরা ঝাঁক বেঁধে ডাকতে ডাকতে উড়ে যাওয়ার সময় কুদ্দুসের সরালিগুলো একটু যেন উদাস হয়ে যেত। তবে মিশত না ওদের সঙ্গে, স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখত পোষা হাঁসের সঙ্গেও। কুদ্দুস ডাক দিলে ডাকের সীমানায় থাকলে হাঁসগুলো উড়ে চলে আসত। কুদ্দুসের হাতের ভাষাও বুঝত ওরা, বুঝত ভালোবাসা।
২০০৪ সালের ডিমগুলো থেকে ছানা ফোটেনি। ওই সালেই এক রাতে খাঁচার নেট ছিঁড়ে ভেতরে ঢোকে একটি মেছো বাঘ। হাঁসগুলোর সে কী করুণ চিৎকার ও দাপাদাপি-ঝাপাঝাপি! বাড়ি থেকে দৌড়ে আসেন প্রভু। টর্চ জেলে দেখেন, একটি হাঁসকে মেরেছে, আরেকটিকে মুখে ধরে আছে মেছো বাঘটি।
২০০৫ সালেও ডিম ফুটল না−একই কারণে। তখন হাঁস আছে মাত্র চারটি। দুটি পুরুষ, দুটি মেয়ে। বাকিগুলো লোভী চিংড়িশ্রমিকেরা ধরে খেয়ে ফেলেছে। মানুষকে ভয় তো পেত না। প্রভুর বুকে আহাজারি। চোখে কান্না। নিজের সন্তানের মতোই যে হাঁসগুলো!
২০০৬ সালেও ডিম ফুটে ছানা হলো না। একটি মেয়েপাখিও হারিয়ে গেল লোভী মানুষের পেটে। রইল বাকি তিনটি। কুদ্দুস খাঁচাবন্দী রাখতে চান। হাঁস তিনটি প্রভুর কাছে করুণ মিনতি করে। কী আর করা, ছাড়াই রইল। আশপাশের মানুষজন সবাই জানত হাঁসগুলোর কথা।
২০০৭ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কুদ্দুসের বাড়িতে আবারও যাই আমি, তানভীর খান ও শিপলু খান। খাঁচায় নেই। ডাক দেওয়া হয়। একটি আসে, অনেকক্ষণ উড়ে-ঘুরে নামে একটি ছোট পুকুরে।
তানভীর খানকে ভালো ভালো পোজ দেয়। খুব কাছেও আসে।
২০০৮ সালের জানুয়ারিতে ওই তিনটি পাখিও যায় এক ঘের-মালিকের পেটে। তার ঘেরে নামত। সে অভিযোগও করেছিল মাছ খাওয়ার। কিন্তু আটকে রাখতে পারেননি কুদ্দুস। আটকালেই হাঁসগুলো কাঁদত, মিনতি করত; কুদ্দুস তা বুঝত। রোজ গোধুলিবেলায় হাঁসগুলো অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে ঘুরে উড়ত পাইকপাড়ার মাথায়; তারপর ঢুকত খাঁচায়।
পাখিগুলো নেই। কুদ্দুস সে শোক ভুলতে পারছেন না আজও। হঠাৎ হঠাৎ তাঁর কানে ভেসে আসে যেন হাঁসগুলোর ডাক। চমকে চমকে ওঠেন। স্বপ্নেও দেখেন পাখিগুলোকে।
এই পাখিগুলোকে নিয়ে তিনি অনেক শোকের কবিতা লিখেছেন; বলা যায় হূদয়ের শোকগাথা। বাড়ি গেলে এবার আমি সংগ্রহ করব ওগুলো। পাখিকে ভালোবেসে পাখির শোকে কজন আর লিখতে পারে এমন শোকগাথা?
প্রথম আলো। ৩১ মে ২০০৮

0 comments:

Post a Comment

http://bdbird.blogspot.com