মথুরার ছানা
মথুরার ছানা
শরীফ খান
বনে আজ জবর গরম। বাতাস বন্ধ। ছন্দে ছন্দে উড়ছে না লম্বা লেজের ভিমরাজ। অন্য পাখিদেরও কলরব নেই। নিজ্ঝুম বন।
শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফরেস্টে আছে অনেক ছোট-বড় পাহাড়ি ছড়া। শীতকালে শুকনো থাকে ছড়াগুলো। গরমকালে জল থাকে ঝিরিঝিরি। বর্ষায় টইটুম্বুর।
এখন বোশেখ মাস। দুপুরবেলা একটি ছড়ার ঝিরিঝিরি জলের পাশে চরছে একজোড়া মথুরা, সঙ্গে সাতটি ছোট ছোট ছানা। দেখতে মুরগি ছানার মতো। মথুরা সুন্দর পাখি। শরীরের গড়ন লম্বাটে, লম্বা লেজটা দেখতে অনেকটা ময়ুরের লেজের মতো। মাথায় খুব সুন্দর ঝুঁটি, সেটা পিঠ বরাবর বয়ে গেছে। চোখের চারপাশটা আলতা-লাল। মথুরাদের দেখতে যেমন কিছুটা ময়ুর ময়ুর লাগে, তেমনি মোরগ মোরগও লাগে। হ্যাঁ, এরা ময়ুর এবং মোরগ-মুরগিদের জাতভাই। লাওয়াছড়া বনে বনমোরগ-মুরগিও আছে। মিলেমিশে চরে ওরা। মথুরার ইংরেজি নাম কালিজ পিজ্যান্ট, অনেকে বলে কালো ময়ুর। সিলেট-চট্টগ্রামের টিলাময় পাহাড়ে এরা থাকে।
এই যে গরমের দুপুরে ছড়ার পাশে চরছে মা-বাবা আর সাতটি ছয়-সাত দিন বয়সী ছানা, ওরা খাচ্ছে পোকামাকড়। মা-বাবা ছড়ার পাশের নরম মাটি ও শুকনো ভেজা লতাপাতা পা দিয়ে আঁচড়ে আঁচড়ে পোকামাকড় বের করে দিচ্ছে, ছানারা খাচ্ছে। মা-বাবা পাখি বারবার মাথা তুলে এদিক-সেদিক দেখছে। কান পাতছে। বিপদ এলে পালাতে হবে না! এ বনে শত্রুর অভাব নেই। যে ঘন বন! অজগর, গুইসাপ, মেছোবাঘ, বাজ, ঈগলসহ কত না শত্রু। এমনকি সোনাব্যাঙেরাও সুযোগ পেলে কচি কচি ছানা ধরে গিলে ফেলে।
ছড়ার পাশে ঘুরে ঘুরে বেশ খাওয়া-দাওয়া হলো। মোট নয়টি পাখি ছড়া থেকে জল পান করল অদ্ভুত ভঙ্গিতে। তারপর মা পাখিটি এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল একটি ফার্ন ঝোপের পাশে। ছানাগুলো দৌড়ে মায়ের পাশে দাঁড়াল। মা ঠিক পোষা মুরগির কায়দায় ছানাগুলোকে বুক, পেট ও ডানার তলায় আগলে বসে গেল গোলগাল হয়ে। পাশে এক পায়ে দাঁড়িয়ে, পিঠে ঠোঁট গুঁজে বিশ্রাম করতে লাগল বাবা পাখি। বহুদুরে ডাকছে একটি বনমোরগ। সুরেলা শিস বাজাচ্ছে একটি শ্যামা পাখি। বনমুরগির একটি মাঝবয়সী ছানা ‘ট্যাও ট্যাও’ শব্দে কাঁদছে ওদিকের বেতঝোপটার পাশে। মাকে হারিয়ে ফেলেছে ও।
ছড়া ধরে হেলতে-দুলতে নেমে আসছে একটা মস্ত বড় মেছোবাঘ। নিশাচর এরা। ওদিকের ঝোপে ঘুমিয়ে ছিল। মথুরা দেখে লোভ জেগেছে। তাই মাথা নিচু করে এগিয়ে আসছে গুটি গুটি। কাছাকাছি পৌঁছে যখন লেজ দুলিয়ে দুলিয়ে লাফ দিতে উদ্যত বাঘের এই মেছোমাসি, তখন আচমকা বাবা-পাখিটি পিঠ থেকে মাথা তুলে ‘পালা পালা’ ধরনের ডাক ছেড়েই ছিটকে উঠল শুন্যে−উড়াল দিল বনতল ধরে। মুহুর্তেই ছিটকে উঠল মা-পাখি। চারদিক ছিটকে গেল সাতটি পুচকে ছানা, ‘পালা পালা’ চিৎকার করে মা-ও দিল উড়াল। ছানারা উধাও। যেন-বা হাওয়া হয়ে গেছে। তেড়ে এল মেছোবাঘ। আশপাশে তন্ন তন্ন করে খুঁজল। পেল না একটি ছানাও। ফিরে গেল সে। ২০ মিনিট বাদে ফিরে এল মা-বাবা। গলায় তুলল অভয় সংকেত। ও মা! গুড় গুড় করে ছানারা এসে জড়ো হলো মায়ের পাশে। ছিল কোথায় ওরা?
মথুরার ছানারা অতিশয় চালাক। আত্মগোপন করতে জানে ভালো। মা-বাবার সব ধরনের সংকেত বোঝে ও মানে। শত্রুর ধাওয়া খেয়ে মা-বাবাকে হারিয়ে ফেললে একসময় এরাও কেঁদে কেঁদে মা-বাবাকে খোঁজে। মা-বাবা কান্না শুনেই ছানাদের খোঁজ পায়।
বনমোরগ-মুরগির মতো মথুরারাও বাসা করে মাটিতে। সাত-আটটি ডিম পাড়ে। মা-পাখি ডিমে তা দেয়। ছানা ফোটে ২০-২৫ দিনে। তার পরে মা-বাবার সঙ্গে সঙ্গে চরে। ছয়-সাত দিন বয়স হলেই ছানারা যথেষ্ট চালাক হয়ে যায়। মা-বাবার সঙ্গে থাকে অনেক দিন পর্যন্ত। চার থেকে ছয় মাস বয়স হলে উড়তে পারে।
মথুরার ছোট ছানাদের চোখের পাশ থেকে একটি সরু কালো টান বাঁকা হয়ে ঘাড় পর্যন্ত নামানো থাকে। বুক হালকা বাদামি। পিঠ হালকা খয়েরি। পা কালচে। মাথার তালু হালকা বাদামি। চকচকে তেলতেলে কপাল। চোখের পাশটাও একই রকম। এদের পিঠের মাঝখানটায় থাকে একটিপ বাদামি চকোলেট রং। দুর থেকে একনজরে ছোট ছানারা বাফ্রঙা। বুক-পেট হলুদাভ-ছাই। এই বয়সী ছানা দেখলে মুগ্ধ হতে হয়। বয়স যত বাড়তে থাকে, রং ততই খুলতে থাকে। লেজের লম্বা বাহারি পালক বেশ গজিয়ে যায়। পায়ের গোড়ার পালকগুলো হয় হালকা ছাই-বাদামি ও সাদা। মনে হয় শর্টপ্যান্ট, রং সাদা। পা হালকা হলুদাভ। লেজের ওপরটা খয়েরি, ডানাটা সাদা-কালো ডোরায় ভরে ওঠে। চোখের পাশটায় আলতা রং ফোটে। পিঠ হয় হালকা খয়েরি, তাতে কালো ও হলুদাভ ছিটছোপ ফোটে। মাথার তালু ও চোখের পাশটা হয় কালচে। এই ছানা যখন চার-ছয় মাস বয়সী হয়, তখন দেখতে দারুণ সুন্দর লাগে। পাঁচ-সাতটি ছানা একত্রে উড়লে চারপাশে যেন নানা রকম রং ছড়িয়ে পড়ে।
মথুরার ছানা বন্দী করে পোষা যায়। পোষা অবস্থায় এরা খায় কচি ঘাস, কাউন, চিনাদানা, ধান, মাসকলাই, আস্ত মুগডাল, ধান, চাল ইত্যাদি। বনে এরা উইপোকাসহ নানা রকম পোকামাকড়, কীটপতঙ্গসহ ঘাস ও ঘাসের বীজ এবং মাটিতে পড়া ফল-পাকুড় খায়।
ছোট ছানাদের কন্ঠও হয় চড়া। জোরালো কন্ঠ। ডাকের ভাষা ‘ক্যার ক্যার’ ধরনের। ছোট ছানাদের শরীরে যখন উইপোকা উঠে পড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ও কামড়ায়, তখন ছানারা চেঁচায় আর লাফায়। সে এক মজার দৃশ্য। কেঁচো নিয়ে পিচ্চি ছানারা যখন টানাটানি লাগায়−কেঁচোটি ছিঁড়ে যায় ও ছানারা চিৎপটাং হয়, তখনো দেখতে মজাই লাগে। আবার উড়ন্ত পোকা ধরতে যখন ধাওয়া করে ছানারা লাফ দেয়, কিন্তু ধরতে পারে না, তখনো ওদের মুখখানা হয় দেখার মতো। ছানারা দৌড়াতে পারে খুব দ্রুত। মুরগির তায়ে মথুরার ডিম ফোটানো যায়। তখন মুরগি-মাতার সঙ্গেই চরে।
নানা কারণে মথুরা কমে গেছে ও যাচ্ছে। ছানা নিয়ে চরছে মথুরা, এমন দৃশ্য থেকে যেন বঞ্চিত না হয় শিশু-কিশোরেরা।
ছবি: তানভীর খান
সূত্র: প্রথম আলো, ২৫ জানুয়ারি, ২০০৮
0 comments:
Post a Comment