Saturday, May 17, 2008

মথুরার ছানা

মথুরার ছানা

শরীফ খান

বনে আজ জবর গরমবাতাস বন্ধছন্দে ছন্দে উড়ছে না লম্বা লেজের ভিমরাজঅন্য পাখিদেরও কলরব নেইনিজ্ঝুম বন

শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফরেস্টে আছে অনেক ছোট-বড় পাহাড়ি ছড়াশীতকালে শুকনো থাকে ছড়াগুলোগরমকালে জল থাকে ঝিরিঝিরিবর্ষায় টইটুম্বুর

এখন বোশেখ মাসদুপুরবেলা একটি ছড়ার ঝিরিঝিরি জলের পাশে চরছে একজোড়া মথুরা, সঙ্গে সাতটি ছোট ছোট ছানাদেখতে মুরগি ছানার মতোমথুরা সুন্দর পাখিশরীরের গড়ন লম্বাটে, লম্বা লেজটা দেখতে অনেকটা ময়ুরের লেজের মতোমাথায় খুব সুন্দর ঝুঁটি, সেটা পিঠ বরাবর বয়ে গেছেচোখের চারপাশটা আলতা-লালমথুরাদের দেখতে যেমন কিছুটা ময়ুর ময়ুর লাগে, তেমনি মোরগ মোরগও লাগেহ্যাঁ, এরা ময়ুর এবং মোরগ-মুরগিদের জাতভাইলাওয়াছড়া বনে বনমোরগ-মুরগিও আছেমিলেমিশে চরে ওরামথুরার ইংরেজি নাম কালিজ পিজ্যান্ট, অনেকে বলে কালো ময়ুরসিলেট-চট্টগ্রামের টিলাময় পাহাড়ে এরা থাকে

এই যে গরমের দুপুরে ছড়ার পাশে চরছে মা-বাবা আর সাতটি ছয়-সাত দিন বয়সী ছানা, ওরা খাচ্ছে পোকামাকড়মা-বাবা ছড়ার পাশের নরম মাটি ও শুকনো ভেজা লতাপাতা পা দিয়ে আঁচড়ে আঁচড়ে পোকামাকড় বের করে দিচ্ছে, ছানারা খাচ্ছেমা-বাবা পাখি বারবার মাথা তুলে এদিক-সেদিক দেখছেকান পাতছেবিপদ এলে পালাতে হবে না! এ বনে শত্রুর অভাব নেইযে ঘন বন! অজগর, গুইসাপ, মেছোবাঘ, বাজ, ঈগলসহ কত না শত্রুএমনকি সোনাব্যাঙেরাও সুযোগ পেলে কচি কচি ছানা ধরে গিলে ফেলে

ছড়ার পাশে ঘুরে ঘুরে বেশ খাওয়া-দাওয়া হলোমোট নয়টি পাখি ছড়া থেকে জল পান করল অদ্ভুত ভঙ্গিতেতারপর মা পাখিটি এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল একটি ফার্ন ঝোপের পাশেছানাগুলো দৌড়ে মায়ের পাশে দাঁড়ালমা ঠিক পোষা মুরগির কায়দায় ছানাগুলোকে বুক, পেট ও ডানার তলায় আগলে বসে গেল গোলগাল হয়েপাশে এক পায়ে দাঁড়িয়ে, পিঠে ঠোঁট গুঁজে বিশ্রাম করতে লাগল বাবা পাখিবহুদুরে ডাকছে একটি বনমোরগসুরেলা শিস বাজাচ্ছে একটি শ্যামা পাখিবনমুরগির একটি মাঝবয়সী ছানা ট্যাও ট্যাওশব্দে কাঁদছে ওদিকের বেতঝোপটার পাশেমাকে হারিয়ে ফেলেছে ও

ছড়া ধরে হেলতে-দুলতে নেমে আসছে একটা মস্ত বড় মেছোবাঘনিশাচর এরাওদিকের ঝোপে ঘুমিয়ে ছিলমথুরা দেখে লোভ জেগেছেতাই মাথা নিচু করে এগিয়ে আসছে গুটি গুটিকাছাকাছি পৌঁছে যখন লেজ দুলিয়ে দুলিয়ে লাফ দিতে উদ্যত বাঘের এই মেছোমাসি, তখন আচমকা বাবা-পাখিটি পিঠ থেকে মাথা তুলে পালা পালাধরনের ডাক ছেড়েই ছিটকে উঠল শুন্যেউড়াল দিল বনতল ধরেমুহুর্তেই ছিটকে উঠল মা-পাখিচারদিক ছিটকে গেল সাতটি পুচকে ছানা, ‘পালা পালাচিৎকার করে মা-ও দিল উড়ালছানারা উধাওযেন-বা হাওয়া হয়ে গেছেতেড়ে এল মেছোবাঘআশপাশে তন্ন তন্ন করে খুঁজলপেল না একটি ছানাওফিরে গেল সে২০ মিনিট বাদে ফিরে এল মা-বাবাগলায় তুলল অভয় সংকেতও মা! গুড় গুড় করে ছানারা এসে জড়ো হলো মায়ের পাশেছিল কোথায় ওরা?

মথুরার ছানারা অতিশয় চালাকআত্মগোপন করতে জানে ভালোমা-বাবার সব ধরনের সংকেত বোঝে ও মানেশত্রুর ধাওয়া খেয়ে মা-বাবাকে হারিয়ে ফেললে একসময় এরাও কেঁদে কেঁদে মা-বাবাকে খোঁজেমা-বাবা কান্না শুনেই ছানাদের খোঁজ পায়

বনমোরগ-মুরগির মতো মথুরারাও বাসা করে মাটিতেসাত-আটটি ডিম পাড়েমা-পাখি ডিমে তা দেয়ছানা ফোটে ২০-২৫ দিনেতার পরে মা-বাবার সঙ্গে সঙ্গে চরেছয়-সাত দিন বয়স হলেই ছানারা যথেষ্ট চালাক হয়ে যায়মা-বাবার সঙ্গে থাকে অনেক দিন পর্যন্তচার থেকে ছয় মাস বয়স হলে উড়তে পারে

মথুরার ছোট ছানাদের চোখের পাশ থেকে একটি সরু কালো টান বাঁকা হয়ে ঘাড় পর্যন্ত নামানো থাকেবুক হালকা বাদামিপিঠ হালকা খয়েরিপা কালচেমাথার তালু হালকা বাদামিচকচকে তেলতেলে কপালচোখের পাশটাও একই রকমএদের পিঠের মাঝখানটায় থাকে একটিপ বাদামি চকোলেট রংদুর থেকে একনজরে ছোট ছানারা বাফ্রঙাবুক-পেট হলুদাভ-ছাইএই বয়সী ছানা দেখলে মুগ্ধ হতে হয়বয়স যত বাড়তে থাকে, রং ততই খুলতে থাকেলেজের লম্বা বাহারি পালক বেশ গজিয়ে যায়পায়ের গোড়ার পালকগুলো হয় হালকা ছাই-বাদামি ও সাদামনে হয় শর্টপ্যান্ট, রং সাদাপা হালকা হলুদাভলেজের ওপরটা খয়েরি, ডানাটা সাদা-কালো ডোরায় ভরে ওঠেচোখের পাশটায় আলতা রং ফোটেপিঠ হয় হালকা খয়েরি, তাতে কালো ও হলুদাভ ছিটছোপ ফোটেমাথার তালু ও চোখের পাশটা হয় কালচেএই ছানা যখন চার-ছয় মাস বয়সী হয়, তখন দেখতে দারুণ সুন্দর লাগেপাঁচ-সাতটি ছানা একত্রে উড়লে চারপাশে যেন নানা রকম রং ছড়িয়ে পড়ে

মথুরার ছানা বন্দী করে পোষা যায়পোষা অবস্থায় এরা খায় কচি ঘাস, কাউন, চিনাদানা, ধান, মাসকলাই, আস্ত মুগডাল, ধান, চাল ইত্যাদিবনে এরা উইপোকাসহ নানা রকম পোকামাকড়, কীটপতঙ্গসহ ঘাস ও ঘাসের বীজ এবং মাটিতে পড়া ফল-পাকুড় খায়

ছোট ছানাদের কন্ঠও হয় চড়াজোরালো কন্ঠডাকের ভাষা ক্যার ক্যারধরনেরছোট ছানাদের শরীরে যখন উইপোকা উঠে পড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ও কামড়ায়, তখন ছানারা চেঁচায় আর লাফায়সে এক মজার দৃশ্যকেঁচো নিয়ে পিচ্চি ছানারা যখন টানাটানি লাগায়কেঁচোটি ছিঁড়ে যায় ও ছানারা চিৎপটাং হয়, তখনো দেখতে মজাই লাগেআবার উড়ন্ত পোকা ধরতে যখন ধাওয়া করে ছানারা লাফ দেয়, কিন্তু ধরতে পারে না, তখনো ওদের মুখখানা হয় দেখার মতোছানারা দৌড়াতে পারে খুব দ্রুতমুরগির তায়ে মথুরার ডিম ফোটানো যায়তখন মুরগি-মাতার সঙ্গেই চরে

নানা কারণে মথুরা কমে গেছে ও যাচ্ছেছানা নিয়ে চরছে মথুরা, এমন দৃশ্য থেকে যেন বঞ্চিত না হয় শিশু-কিশোরেরা

ছবি: তানভীর খান

সূত্র: প্রথম আলো, ২৫ জানুয়ারি, ২০০৮

0 comments:

Post a Comment

http://bdbird.blogspot.com