বিশ্বসফরে রেকর্ড করেছে যে পাখি
রেজা খান
বিশ্বে বার্ডফ্লুর যে প্রকোপ চলছে, তাতে প্রাকৃতিকভাবে ঘুরে বেড়ানো পাখিদের ভুমিকা কী, তা নিয়ে গবেষণা করছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সরকারি সংস্থা ও নিউজিল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক-গবেষক। তারই অংশ হিসেবে সাতটি জোয়ালা পাখির পায়ে হালকা ও মজবুত আংটি পরিয়ে দেন তাঁরা। প্রতিটির পিঠে বসিয়ে দেন ব্যাটারিচালিত হালকা স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার।এসব যন্ত্রপাতি নিয়ে ২০০৭ সালের ১৭ মার্চ অন্য পাখিগুলোর সঙ্গে ই-৭ (পায়ে পরানো আংটির নম্বর) বার-টেইলড গডউইট প্রজাতির স্ত্রী পাখিটিও নিউজিল্যান্ডের উত্তর আইল্যান্ডের মিরান্ডা থেকে উড়তে শুরু করে। কোথাও না থেমে এক নাগাড়ে আট দিন উড়ে পাখিটি গিয়ে নামে চীন-উত্তর কোরিয়ার সীমান্তপারের ইয়ালু জিয়াং নদীর তীরে। এ সময় এক উড়ানে পাখিটি অতিক্রম করে প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার। সেখানে ৩৫ দিন কাটিয়ে ১ মে সন্ধ্যায় ফের পাখিটি যাত্রা শুরু করে। একের পর এক পেরিয়ে যায় পূর্বদিকে জাপান সাগর, উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর, উত্তর-পূর্ব দিকে যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কার উপদ্বীপ। পাঁচ দিন পর পাখিটি গিয়ে পৌঁছে পশ্চিম আলাস্কার ইওকুন-কাসকোকুইম নদীর বদ্বীপ অঞ্চলে। জলাভুমির পাখির বহু প্রজাতির সঙ্গে জোয়ালারাও প্রতিবছর এখানে প্রজনন করে। এই পাঁচ দিনের যাত্রায় পাখিটি পাড়ি দেয় সাত ২০০ কিলোমিটার পথ।
পুরো আগস্ট ইওকুন-কাসকোকুইমে কাটিয়ে ২৯ তারিখ ভোরে পাখিটি যাত্রা শুরু করে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। আলাস্কা পেরিয়ে চলে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ পৌঁছে অবিরাম উড়তে থাকে দক্ষিণ-পশ্চিমে। সেখান থেকে ছোটে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ ফিজির দিকে। ৭ সেপ্টেম্বর পড়ন্ত বিকেলে নিউজিল্যান্ডের যে নদীতে গিয়ে পাখিটি নামে, মিরান্ডা সেখান থেকে আট কিলোমিটার। এই মিরান্ডাতেই তার পায়ে আংটি পরানো হয়েছিল। শেষের বিরতিহীন ১০ দিনের উড্ডয়নে পাখিটি পাড়ি দেয় প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কিলোমিটার।
সাত মাসে ই-৭ উড়েছে মোট ২৩ দিন। আর এই ২৩ দিনে পাড়ি দিয়েছে ২৯ হাজার কিলোমিটার। গড়ে পাখি প্রতিদিন উড়েছে এক হাজার ২৬০ কিলোমিটার। তাও বিরতিহীন। পাখিদের বিশ্বভ্রমণে এটি একটি বিশ্বরেকর্ড।
জোয়ালা পাখির জীবনকাল গড়ে প্রায় ২০ বছর। চার বছর বয়সে প্রথম পরিযায়ন শুরু করে। একটি জোয়ালা পাখি তার জীবদ্দশায় উড়ে বেড়ায় চার লাখ ৯৩ হাজার কিলোমিটার।
বাংলাদেশে দুই প্রজাতির জোয়ালা পাওয়া যায়। একটি ডোরা-লেজ জোয়ালা বা বার টেইলড গডউইট (Limosa lapponica), অন্যটি কালো-লেজ জোয়ালা বা ব্ল্যাক-টেইলড গডউইট (Limosa limosa)। প্রথমটি তেমন সুলভ নয়। দ্বিতীয়টি সুলভ। আমাদের হাওর বা মিঠাপানিতে এদের পাওয়া যায়। লম্বা ও সুচালো ঠোঁটের ডগা থেকে লেজের ডগা পর্যন্ত জোয়ালা পাখি লম্বায় ৪২ সেন্টিমিটার, ওজন প্রায় ৪৫০ গ্রাম। এরা নরম বালুবেলা বা কাদাভুমি থেকে কেঁচো-জাতীয় সামুদ্রিক অমেরুদন্ডী প্রাণী খেয়ে জীবনধারণ করে। দলে থাকতে পছন্দ করে। ডোরা-লেজ জোয়ালা মূলত উপকুলীয় জলাভুমি ও মোহনা অঞ্চলের পাখি। এরা পরিযায়ী। দেখা যায় কেবল ভরা শীতে। শীত শেষে ফিরে যায় রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চলে বা উত্তর এশিয়ায়।
সবচেয়ে দুরবর্তী দেশ থেকে যেসব পাখি বাংলাদেশে আসে, জোয়ালা তাদের অন্যতম। সাইবেরিয়া থেকে আমাদের উপকুলে পৌঁছাতে এদের কমপক্ষে সাত-আট হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। ফিরতি পথেও অতিক্রম করতে হয় ফের একই পথ। আমাদের দেশের জোয়ালাদের নমুনা প্রতিবছর কোত্থেকে কত কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে এখানে আসে, সেটি জানা যাবে আমরা যখন এ পাখির নমুনার পায়ে আংটি ও পিঠে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসানোর সুযোগ পাব। সে সুযোগ কি আমাদের ভাগ্যে জুটবে?
সূত্র: প্রথম আলো। ২৩ মে ২০০৮
0 comments:
Post a Comment